Monday 1 May 2017

প্রেম-ট্রেম


কয়েকদিন ধরে মাথার ভিতরে শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে রবির। এই জীবনে কি করলাম, কেন করলাম আর এত কিছু করে কোথায়ই বা যাব- এত সব আধ্যাত্নিক চিন্তা। ওর প্রিয় বন্ধু সোহেলকে বলতেই ও বলে- তুই এত চিন্তা করার টাইম পাস কেম্নে? আমি তো প্রাইভেট, ডার্লিং, কোচিং করে ওগুলা নিয়া ভাবতেই পারি না। মামা, তুই একটা বরং প্রেম-ট্রেম কর।
রবির বেশির ভাগ বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড আছে, কেউ ইয়াবাখোর কেউ গাজায় দুটা টান দিয়ে কারে করে রাতে ঘোরাঘুরি করা মডার্ন হিমু, নয়তো কেউ পরকীয়া আসক্ত নারীর ইয়ো-ইয়ো টাইপ জীবনের বা অবিচ্ছেদ্য বিনোদনের পার্টনার।

২২ বছর বয়সেই রবির কত না গার্লফ্রেন্ড আর কত না নাম না জানা মধুমক্ষিকা! সুমি, মৌ, রুমা, আফসানা, বব কাট, এলো চুল, কার্ল করা চুল, সেলোয়ার কামিজ, লেহেঙ্গা, আরো কত নাম না জানা কত জন! রবি নামগুলোও ঠিক মত মনে করতে পারেনা। বাড়তি হিসেবে ও পেয়েছে নেশা করার অবারিত সুযোগ। রুমা যখন ওকে ফিজিকালি এটাচড হতে দিল না, জীবনে প্রথম গাজা খায় ও। কয়েকমাস গাজা টানার পর মৌ বাঁচায় ওকে এক ক্লাবের ভেতর থেকে ড্রিংক্স করারত অবস্থায়। মৌ ওকে ইয়াবা দিলে ও পরম আদরে ইয়াবা ও মৌ দুটোকেই কাছে টেনে নেয়। তারপরে তো মৌ ছাড়া ওর ফ্লাটে রাতে ফেরাই হতো না। রবির আব্বু থাকে আমেরিকায়, আম্মু বিভিন্ন সোসাল ওয়্যারকে ব্যস্ত, মাসে দুতিনদিন বাসায় থাকেন-যেদিন থাকেন রবিকে নিয়ে ঘুরতে যান পছন্দের কোন শপিংমলে, দরকারি হোক বা অদরকারি কেনা কাটা করে বেশ রাত করে ঘরে ফেরেন আর হই-হুল্লোড় করে হিন্দি মুভি দেখেন অনেক রাত করে ওকে সাথে নিয়ে। তাছাড়া রবির সারাটা মাস প্রায় একাই কাটে এক রহমত চাচা ছাড়া।
রবির এইরকম স্বাধীন জীবনে প্রথম ছন্দ পতন নামায় বাসার রহমত চাচা। রহমত চাচাকে একদিন রবি বলে ফেলে- আপনি নিজের বাসায় যান না কেন চাচা? এইখানে আপনার কে আছে? চাচা বেশ সরল মনেই বলে- বাবারে যেতে তো হবে কবরেই একদিন, যখন যাবো কাউকে বলবো না, কাউকে কিছু দিব না- ছোট এই কথাটি রবির ভেতর বসে গেলো পাথর হয়ে। টিভি দেখে, নাস্তা করে, মাঠে গিয়ে ছেলেদের খেলা দেখে, ল্যাপটপে গেম খেলে, ভার্সিটিতে যায়, ফিরে আসে, বন্ধুদের আডদায় আগে যেমন প্রাণ-খোলা ভাব ছিল- তেমন টা আর রবির মাঝে দেখা যায় না।
একদিন রবির পুরনো হয়ে যাওয়া গার্লফ্রেন্ড আফসানা ফোন দিয়ে তাকে বলে- জানু, আমার নতুন হাবিটা কীযে সুইট হইছে, তুমি যদি দেখতে- আমার সাথে ভিডিও চ্যাট না করে সে কোনদিন ঘুমাতেই যায় না......তোমার মৌ রাণীর কি খবর? রবির মাথার ভেতরে একরাশ শূন্যতা ভরা আকাশ- এই আকাশের মাঝে ফিকে হয়ে যাওয়া পাখিদের আর ধরতে মন সায় দেয় না, কিছু না বলেই খুট করে রেখে দেয় ও। আসলেই তো কয়েকদিনের জীবনে এই প্রেম-ভালবাসা-দেহ-স্পর্শ-ভালো লাগা- না ভালো লাগা সেয়ারিং এগুলার কী আসলেই কোন ভ্যালু আছে? নিজের বাবা-মাকেই তো সে কোনদিন দেখে নি, দেখেনি তাদের আবেগ- ক্রোধ-ভালবাসা-ইত্যাদি ভাগাভাগি করতে......সে কেমন করে বুঝবে ওগুলোর ভেতরে কী আছে- এতসব ভাবতে ভাবতে তুখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল প্রায়। আজ সারাটা দিন রবি এখানেই বসে ছিল-পার্কের ভিতরে। সোহেল ফোন দিয়েছিলো কয়েক বার- রহমত চাচা দিয়েছিলো- কারো ফোন ধরে নি ও। দুপুরের ক্ষুধা কখন যে মরে গেছে টেরই পায়নি।
হঠাৎ সালাম আর হাসি দিয়ে ক্লিন-শেভড একজন মাঝবয়সী হ্যান্ডসাম লোক প্রায় চমকে দেয় রবিকে। হাওয়াই সার্ট পরা ভদ্রলোকের এমন আচরণে সালামের প্রত্যুত্তর দেয়ার পরিবর্তে রবি শুধু বলে- ভালো আছি। আপনি ভালো ত? লোকটার হাসি আরো বিস্তৃত হয়, বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে বলেন- হ্যাঁ, ভালো, কেমন গরম পড়েছে, দেখেছেন? পার্কে বেশ অনেক ক্ষণ ধরে বসে আছেন তো আপনি তাই গল্প করার লোভ সামাল দিতে পারলাম না। লোকটার আন্তরিকতা দেখে ও বলে বসে- আপনি আমার চেয়ে অনেক বড়, তুমি করে বলতে পারেন আমাকে, আমি রবি। লোকটা খুব আনন্দিত হবার ভঙ্গিমা করে বলেন- ডিজিটাল যুগের ছেলেরা তো আমাদের চাইতে অনেক ফাস্ট, তো এই মোবিলিটির উপর বেসিস করে আপনাকে কিন্তু আপনি হিসেবেই মানায়- তুমিতে নয়, যাই হোক রবি- দুপুরের ভাত খেয়েছ? কতদিন পর রবিকে একথা রবিকে কেউ বলল, চোখে প্রায় তার পানি এসে যায়। রবি পানি লুকাতে লুকাতে বলে- আমার বাসায় ভাত নিয়ে বসে আছে, সেখানে খাব। আপনি কি কিছু বলবেন আমায়?
লোকটি সপ্রতিভ হয়ে উত্তর দেয়- ও ঠিক আছে তাহলে, তোমার মা তোমার জন্য ওয়েট করছে। অন্য আরেক সময়ে তোমার সাথে কথা বলব রবি। আর পারেনা রবি চোখের পানি লুকাতে, কান্নার দমকে চমকে ওঠে লোকটি, রবির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন- চল তো, আমরা আজ বিরিয়ানি খাব, তুমি আমার গেস্ট, আজ আমার বাসায় থাকবে তুমি।
রবি নির্দ্বিধায় উঠে পরে লোকটার সাথে- চুম্বকের মত আকর্ষণ লোকটার কথার মাঝে, সাথে জাদুকরী অ্যাটিচুড। উঠতে উঠতে বলে- আপনার নামটাই ত জানা হল না--, লোকটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে- আমাকে আনিস ভাই ডাকতে পারো, আমি প্রাইভেট একটা ফার্মে ফ্রিল্যান্স কাজ করি- মানে দুদিন কাজ করি ত চার দিন খই ভাজি আর কি- বলে ঠা ঠা করে হাস্তে থাকেন। রবিও সাথে সাথে হাস্তে থাকে।
রিক্সা এসে দুজনকে নিয়ে নামে পুরাতন ঢাকার হাজির বিরিয়ানির দোকানে। প্রচুর লোক। প্যাকেট ভর্তি করে সবাই বিরিয়ানি নিয়ে যাচ্ছে, কেউ হাপুস-হুপুস শব্দে খেয়ে চলেছে, ধানমণ্ডির ঝামেলামুক্ত জীবন ছেড়ে কোলাহল-মুখর ব্যস্ত এক দোকানে আনিস ভাইয়ের সাথে এসে রবির ভেতর থেকে যেন পাথরটা নেমে যায়, আনিস ভাইকে প্রায় শিশুর মত করে বলে- ভাইয়া, চলেন আমরা বাসায় বিরিয়ানি প্যাকেট করে নিয়ে যেয়ে খাই। আনিস বলে- ঠিক আছে, তাই হবে। আনিস ভাইয়ের বাসা সলিমুল্লা মেডিক্যালের পাশে। পুরাতন ঢাকার বাড়িগুলো যেমন ঘিঞ্জি হয়- তেমন নয় বেশ খোলামেলা একটা ভাব আছে, বিরিয়ানি প্লেটে তুলতে তুলতে আনিস বলে- আমার বাবা ছিলেন পাকিস্তান পিরিয়ডের এস।পি, তার বাবা মানে আমার দাদা ছিলেন বিশাল জমিদার, দাদার হাতে করা এই বাড়িতে আমি আর আমার এক ম্যানেজার থাকি এখন। রবির বলতে ইচ্ছে করে আনিস ভাইয়ের ফ্যামিলি কই, বাচ্চা-কাচ্চা কয়জন, ইত্যাদি ইত্যাদি-কিন্তু ভাইয়ের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবটা দেখে আর থামাতে দেয়না তাকে, আনিস ও বকবক করে যেতেই থাকে।
খাওয়া শেষ হলে ডাইনিং রুম ছেড়ে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ায় আনিস, পিছনে মন্ত্রমুগ্ধের মত রবি- ড্রয়িং রুমে বেশ কয়েকটা মন খারাপ করা পেইন্টিং- গাজায় বোমা হামলায় দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা একটা বিল্ডিং-এর সামনে রক্তাক্ত একটা বছর তিনেকের শিশুর ছবি, আইলানের সমুদ্রতীরে পরে থাকা সেই বিখ্যাত ছবি, একটা ছবিতে ইংরেজিতে লেখা যার বাংলা করলে দাঁড়ায়- মানবতা তুমি কী মাটির নিচে বাস করো? পৃথিবীতে ইসলামের সব শত্রু হলো ক্রুসেডার- যাদের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমরাই আনব সেই মানবতা যা সবার জন্য কল্যাণকর- যা ধর্মের জন্য অবশ্যম্ভাবী কাজ এবং পরকালের জন্য অশেষ রহমত ও ইবাদতের কাজ। রবি খুটিয়ে খুটিয়ে ছবিগুলো দেখছিল, পড়ছিল- আনিস ভাই সিগারেট টানছিলেন- একটা তার দিকে দিয়ে বলে- খাবে নাকি? আমি তো গোল্ডলিফ খাই, বেন্সন ছাড়া তোমার চলে ত? রবি লজ্জার মাথা খেয়ে একটা গোল্ডলিফ নিয়ে বলে- ভাই ক্রুসেডার মানে কি? আনিস ভাই বক্তৃতার স্বরে বলে চলেন- ইসলামের সকল শত্রুই ক্রুসেডার। একাদশ-পঞ্চদশ শতাব্দীতে মুসলমান-খ্রিস্টান কয়েকটি সিরিজ যুদ্ধ চলে তখনকার সময়ের পবিত্র নগর জেরুজালেমকে রক্ষা করা জন্য। দুই পক্ষই দাবী করে- জেরুজালেমের অধিকার তাদের, কিন্তু খ্রিস্টান- ইহুদিরা মুস্লিমদের যৌক্তিক দাবীকে পাশ কাটিয়ে বিনা বিচারে জুলুম চালিয়েছে- মানুষ মেরেছে নির্বিচারে- এখনো মারছে নির্বিচারে ফিলিস্তিনে, গাজায়, সোনার মদিনায় আজ আমেরিকার সেনারা মদ খায়- মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করে, সৌদি বাদশাদের সাথে তাদের অন্তরঙ্গ মিল, আরে শালা তোরা আল্লার ঘরের দেশের লোক হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারলিনা? আর আজ আমার বাঘা ইস্লামিক স্টেস-এর বাঘা বাঘা সৈনিক- আল্লার প্রেরিত সাচ্চা মুস্লিম সিরিয়ার প্রায় অর্ধেক দখল করে ফেলেছে আল্লার অশেষ রহমতে। সাদা চামড়া, বিদেশি, বিধর্মী সবাই ক্রুসেডার- মানে আল্লার বিরুদ্ধচারনকারী এবং এদেরকে দেখামাত্র খতম করা বিশেষ সওয়াবের কাজ। তুমি যদি নামাজ না-ও পড় ক্ষতি নেই কিন্তু একটা ক্রুসেডার মেরে বেহেস্তে যাইতেও কপাল লাগে-সবাই পারে না।
রবির রক্ত প্রায় ফুটে ওঠে, তাহলে এতদিন ধরে আই এস নিয়ে যা শুনে এসেছে তার সবই কি ভুল? আনিস ভাইকে তাই ও বলে- ভাই, ইউটিঊবে আই।এস-এর অনেক সেনা যে তলোয়াড়ের এক কোপে মানুষের মাথা কেটে ফেলে- মেয়েদের জোর করে ধর্ষণ করে- ধর্মের বিচারে তা কি ঠিক? আনিস বলে- দেখো রবি, আই।এস কি এতই বোকা তাদের প্রচারের জন্য ইউটিঊaব লাগবে? যে কোন খোলা ময়দানে ওরকম আলখাল্লা পরে কাউকে জবাই করলেই যদি আই।এস হয়ে যায়, তবে আমাদের গুলশানের বাচ্চা-বাচ্চা পোলাপানও ত আই।এস হয়ে যাবে......আসলে আই।এস-এর খেলাফত রাষ্ট্র কায়েমের যে ফান্ডামেন্টাল চিন্তা তা নিয়ে কেউ বলে না, আরে বাবা দু দশটা বিদেশি মারলে ত ধর্মও রক্ষা পাচ্ছে সাথে সাথে বেহেস্তের হুরপরীও ফ্রি- দুনিয়ার পরী গুলা তো কয়েকদিন ইউজ করলে আর ইচ্ছা হয় না করি......কি বলো? গুলশানে যা হয়েছে তাতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে ঐ পাঁচ জন তথাকথিত জঙ্গির, কি লাভ বলো ত? পারলৌকিক লাভ- তুমি নিজের বিচার করেই দেখো না, এত টাকা পয়সা তোমার বাপের, তুমি কি শান্তিতে আছো?
রবির সিগারেট প্রায় শেষের দিকে। ঘরের টিউব লাইটের উজ্জ্বল আলোয় রবি আবারো গাজার রক্তাক্ত শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে, আইলানের নিথর অবস্থায় পরে থাকার দিকে তাকিয়ে, সে নিজেকে বড় অসহায় ভাবে- হঠাৎ তার ভেতরে জান্তব পশু একটা বেরিয়ে পরতে চায়- সে তার আম্মার উপর ক্ষেপে ওঠে- মা শুধু তাকে টাকাই দেখিয়েছেন তাকে, দরদ দিয়েছেন কখনো? –এই যে ভাই কত আদর করে আজ বিরিয়ানি খাওয়ালো অচেনা হয়েও, চেনা মানুষ হয়ে তার নিজের মা ত দূরে থাকুক কোন গার্ল ফ্রেণ্ড কি আজ পর্যন্ত তাকে একবারো খেয়েছে না কি না খেয়েছে তা জিজ্ঞেস করেছে?
-আনিস ভাই, আপনার মোবাইল নাম্বারটা দেন, আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। আজ বাসায় যাই ভাই, সন্ধ্যা হয়ে এল, কাল একটা এসাইনমেন্ট আছে- রাত জাগতে হবে।

আনিস তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে বলে- সিগারেটটা কম করে খেও রবি। আর বেশি রাত করে ঘুমিও না, ব্রেনে চাপ পরে। মানুষের ব্রেন কিন্তু বড় বিচিত্র!

No comments: